ইরাক,সাদ্দামের, সাম্রাজ্যের নতুন অন্ধকূপ

যুদ্ধের ক্ষত সহজে শুকাবার নয়
যুদ্ধের ক্ষত সহজে শুকাবার নয়
আজ ইরাকের পতনের দিন, সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষিত হওয়ার দিন। তাঁকে ফাঁসির দড়ি পরানোর সময় যখন ইরাকি মীরজাফররা টিটকারি করে বলেছিল ‘জাহান্নামে যাও’, অন্তিম মুহূর্তেও অবিচল সাদ্দাম পাল্টা পরিহাস করেন ‘কোন জাহান্নাম, যার নাম ইরাক?’ মার্কিন আগ্রাসনের ১০ বছর পর ইরাক এখন সত্যিই এক নরকের নাম। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ জর্জ বুশ বলেছিলেন, মিশন সম্পূর্ণ, ইরাক স্বাধীন হলো। তার তিন বছর পর
২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ফাঁসি হয় সাদ্দামের। তত দিনে ইরাকে নিহত হয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। তত দিনে সাদ্দামের অন্তিম ভবিষ্যদ্বাণীও ফলে গেছে, সাদ্দামকে যুক্তরাষ্ট্র যে নরকে পাঠাতে চেয়েছিল, ইরাক নিজেই পরিণত হয়েছে তেমন এক নরকে।
দখলদারের জন্য নিপীড়িত জাতির কল্পনাশক্তির চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু নেই। এই ২০ মার্চ বাগদাদ ছাড়ার সময় সাদ্দাম ঘোষণা করেছিলেন, তিনি আবার ফিরে আসবেন। ইরাক দখলের পর সাদ্দামের জন্মস্থান তিকরিতের দেয়ালে তাঁর সমর্থকেরা লিখে রেখেছিল, ‘সাদ্দাম আবার ফিরে আসবেন’। ইরাক যুদ্ধের ১০ বছর পর সত্যিই তিনি আবার ফিরে আসছেন। ইরাকের জনগণের মধ্যে ফিরে আসছে সাদ্দাম জমানার স্মৃতি। সাদ্দামের আমলে নাগরিক স্বাধীনতা না থাকলেও শান্তি ছিল, দেশপ্রেম ছিল, সমৃদ্ধি ছিল, অসাম্প্রদায়িকতা ছিল। এই ইরাক তাই সেই ইরাকের খোঁজ করছে। সেই খোঁজের মধ্যেই উঠে আসছে মুক্ত স্বদেশের জন্য আকাঙ্ক্ষা। যে জাতি সাদ্দামের ফাঁসির দৃশ্য দেখতে বাধ্য হয়েছে, সেই জাতি এখন বুঝেছে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া ‘স্বাধীনতা’র অপর নাম জাতীয় দাসত্ব। এফবিআইয়ের কাছে দেওয়া বন্দী সাদ্দামের জবানবন্দির
একটি কথা মনে পড়ছে। সাদ্দাম বলেছিলেন, ‘এক মুহূর্তের জন্যও আমি ভুলিনি যে আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম...আমরা ছিলাম অবশিষ্ট কিছু স্বাধীনচেতা মানুষ।’ ইরাক দখলের ১০ বছর পর এই কথাটা বিশ্বের অনেকেরই মনে পড়ছে।
আজ যখন সিরিয়ায়ও ইসলামি জঙ্গিদের সামনে ঠেলে দিয়ে বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে জঙ্গি ন্যাটো, তখনো ইরাক যুদ্ধ বিরাট শিক্ষা হয়ে সামনে চলে আসছে। ভাড়াটে যোদ্ধাদের বলা হচ্ছে ‘ইসলামি’ মুক্তিযোদ্ধা আর দেশপ্রেমিকদের দাগানো হচ্ছে ‘ইসলামের শত্রু’ বলে। সাদ্দাম অনেক অপকর্ম করেছেন, বাশার আল-আসাদও মোটেই গণতান্ত্রিক শাসক নন। কিন্তু বিদেশি আগ্রাসন আর দাঙ্গাবাজদের বিপরীতে দেশপ্রেমিক স্বৈরশাসককেই বেছে নেবে মানুষ। ইরাকে সাদ্দামের প্রত্যাবর্তন আর সিরিয়ায় আসাদের টিকে থাকা তারই প্রমাণ।
আগ্রাসনের পর জর্জ বুশ যুক্তরাষ্ট্রকে মুক্তিদাতা হিসেবে দেখান। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমও সেই প্রচারই দেয়। ১৭৯৮ সালে মিসর দখল করে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ঘোষণা করেন, তিনি আসলে মুক্তিদাতা। ১৭৯৮ সালের জুলাই মাসে কায়রোর অভিজাত ব্যক্তিরা এবং আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্বানদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি দাবি করলেন, তিনি একজন মুসলিম। (স্মরণ করুন, সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ২০০৯ সালে দেওয়া ওবামার বক্তৃতা, ইসলামি কায়দায় সালাম, মুক্তির প্রতিশ্রুতি এবং তার বরখেলাপের কথা) কিন্তু মিসরীয়রা এসব ফাঁকিজুঁকি রুখে দাঁড়াতে দেরি করেনি। কয়েক মাসের মধ্যে কায়রোয় ফরাসিদের পায়ের তলার মাটি জ্বলতে থাকে। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শেখ যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি অভিযোগ তোলেন, ‘মোল্লারা আর মুসলিম নেই, তারা ফরাসি হয়ে গেছে।’ আগ্রাসনকারীদের একটাই পরিচয়, তারা আগ্রাসী। ইরাকে মুকতাদা আল সদরকে অনেকে মনে করেছিলেন সেই মিসরীয় তরুণ যোদ্ধার মতো। তেমনি ইরাকের বা সিরিয়ার বা লিবিয়ার আল-কায়েদার ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে আগ্রাসন ডেকে আনা। ইরাকিরাও ফাঁকিজুঁকি বুঝতে শুরু করেছে, কিন্তু তত দিনে তারা হারিয়েছে তাদের রাজনৈতিক সংহতি। দেশে এখন ইরাকি নেই, আছে শিয়া ও সুন্নি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। নিরাপত্তা ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই। সমৃদ্ধি দিবাস্বপ্নের মতো মিলিয়ে গেছে।
ঠিক একই অবস্থা হয়েছিল প্রাকপলাশীর বাংলাতেও। সিরাজের বাংলায় সাম্প্রদায়িক বিভাজন প্রবল ছিল না। মুসলমান নবাবের হিন্দু সেনাপতি বা প্রধানমন্ত্রী থাকা ছিল অতি স্বাভাবিক বিষয়। সিরাজের সঙ্গে জীবন দিয়েছিলেন সেনাপতি মোহনলাল, যেমন সাদ্দামের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত ছিলেন খ্রিষ্টান প্রধানমন্ত্রী তারিক আজিজ। সিরাজউদদৌলাকে হটানোর সময়ও ব্রিটিশরা ঘোষণা করেছিল, তারা দেশ দখল করতে আসেনি, তারা এসেছে সিরাজের অত্যাচার থেকে বাঙালিদের মুক্তি দিতে। তাদের সেই ‘মুক্তি’র ছলনাকে সম্ভব ও জায়েজ করেছিল বাংলার লোভী বণিককুল ও বেইমান সেনাপতি মীরজাফররা। সিরাজের চরিত্রহননের জন্য তৈরি করা হয়েছিল অন্ধকূপ হত্যাকাহিনি। বিদ্যাসাগরের মতো মানুষও তাতে বিশ্বাস করেছিলেন। সাদ্দামকে ধ্বংসের জন্য তেমনি রচনা করা হয়েছিল ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্রের’ গল্প। এখন জানা যাচ্ছে পুরোটাই ছিল ভুয়া। সিআইএকে ভুল তথ্য দিয়েছিল এক বন্দী ও নির্যাতিত ইরাকি। সেই ভুয়া তথ্যই বিশ্ববাসীকে গিলিয়েছিল জর্জ বুশ প্রশাসন এবং বিবিসি-সিএনএনসহ যাবতীয় পশ্চিমা গণমাধ্যম। যুদ্ধের উন্মাদনায় নোয়াম চমস্কির মতো কিছু মানুষ ছাড়া পাশ্চাত্যের বাঘা বাঘা সাংবাদিক আর জাঁদরেল বুদ্ধিজীবীদের কেউই সেই মিথ্যাকে চ্যালেঞ্জ করেননি? প্রমাণহীন সেই অভিযোগে চলে গেল ১০ লাখ মানুষের জীবন। তেমনি সিরাজকে হত্যার প্রায় দেড় শ বছরে না ইংরেজ না স্বদেশি, পণ্ডিতদের কেউই মেপে দেখতে যাননি যে অন্ধকূপ নামক ১৫ বাই ১৮ ফুটের ওই জায়গায় কোনোভাবেই ১৪৬ জন ইংরেজ সেনাকে আটকে রাখা সম্ভব ছিল না; হত্যা করা সম্ভব ছিল না তাদের ১২৬ জনকে। সাম্রাজ্যিক মিথ্যায় শহীদ হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা, গিয়েছিল ইরাকের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি এবং এখন যেমন যাচ্ছে সিরিয়ার। ইরাক যুদ্ধের প্রথম শহীদ তাই সত্য। আজকের ইরাক তাই খুঁজে ফিরছে যুদ্ধের সত্য, সাদ্দামের ইতিহাস।
দখলদার মানুষ দেখে না, সমাজ দেখে না; কেবল ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের মাটি দেখে, দেখে বাজার, শ্রম ও খনিজ সম্পদ। তারা আফ্রিকা দেখে কিন্তু আফ্রিকানদের দেখে না, ফিলিস্তিন দেখে ফিলিস্তিনিদের বাদ দিয়ে, ইরাক দেখে কিন্তু ইরাকি জীবন ধ্বংস করে। ১০ বছর আগে ইরাকে কেবল গণহত্যাই হয়নি, প্রাচীনতম সভ্যতাই ধ্বংস হয়নি, ধ্বংস হয়েছিল মানবতা। বিশ্বের অজস্র মানুষের আস্থা টলে গিয়েছিল পশ্চিমা মানবতায়! যারা নিজ দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী, তারা আবার সাদ্দামের ফাঁসির সমর্থক! যারা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে, তারাই ড্রোন পাঠিয়ে দেশে দেশে নিরীহ মানুষদের হত্যা করে। বছরের পর বছর এসব মিথ্যাকে গর্বের সঙ্গে লালন করে যাচ্ছে পাশ্চাত্যের বিপুলসংখ্যক মানুষ! ইরাক হচ্ছে সেই অন্ধকূপ, যেখানে মানবতা নিহত হয়েছে, যুক্তির মৃত্যু হয়েছে, আইন ও নৈতিকতার বিপর্যয় ঘটেছে।
ইরাক থেকে সেনা সরানো হয়তো সময়ের ব্যাপার, কিন্তু ইতিহাসের ক্ষতটা শিগগিরই সারবার নয়। টুইন টাওয়ার ধ্বংসে সভ্যতা বিলয় পায়নি, বরং বিশ্বব্যাপী জেগেছিল সহানুভূতি। কিন্তু এরপর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে, আরব ও ইউরো-মার্কিন জগতের মধ্যে, মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে যে সভ্যতার সংঘাত এখনো চলছে, তার সূতিকাগার হলো ইরাক। ইরাক তথা আরব যত দিন না স্বৈরশাসক, পুতুল শাসক আর সন্ত্রাস ও তার বিরুদ্ধের যুদ্ধ থেকে মুক্ত হচ্ছে, তত দিন ইরাকেরও মুক্তি নেই, বিশ্বেরও মুক্তি নেই।
 bangnlanews24.com হতে নেওযা।
Previous Post
Next Post

post written by: